“খোয়াবনামা”: ইতিহাসের অলিগলি ও উপন্যাসের স্বপ্নময়তা
বাংলাদেশের সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় “খোয়াবনামা”। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখা এই উপন্যাসটি দেশের ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান। নব্বইয়ের দশকে কলকাতার বাংলাদেশ হাইকমিশনে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্য সেমিনারে ইলিয়াসের সাহসী বক্তব্যের প্রতিফলন যেন এই বইটি। তিনি সেখানে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের উপন্যাসের ভাষা হবে দেশের জনগণের মুখের ভাষার কাছাকাছি, তা পশ্চিম বাংলার বাংলা ভাষার সাথে যতই আলাদা হোক না কেন। সেই বক্তব্যের সূত্র ধরে ইলিয়াসের “খোয়াবনামা” উপন্যাসটি হয়ে ওঠে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষার প্রতিচ্ছবি।
খোয়াবনামা উপন্যাসের পটভূমি ও চরিত্র
“খোয়াবনামা” একটি ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাস। এটি মূলত তেভাগা আন্দোলন, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, ছেচল্লিশের নির্বাচন, সাতচল্লিশের দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং এসব ঘটনার সামাজিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে গঠিত। উপন্যাসটির পটভূমি কাৎলাহার বিল ও তার আশপাশের গ্রামগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও, এর পরিধি বিস্তৃত হয়েছে পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত।
উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্রগুলো যেমন তমিজ, তমিজের বাপ, কুলসুম, ফুলজান, কাদের, হুরমতুল্লাহ, তাদের জীবনের গল্পের সাথে ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকে যেমন মজনু শাহ, সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা প্রমুখকে দক্ষতার সাথে মিশিয়েছেন ইলিয়াস।
ভাষা ও শৈলী
“খোয়াবনামা” উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ব্যবহার করেছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের আঞ্চলিক ভাষা। তাঁর এই ভাষা ব্যবহারের ধারা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পদ্মানদীর মাঝি” উপন্যাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে, এখানে ভাষার ব্যবহারের পাশাপাশি ইলিয়াস তুলে এনেছেন সেই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষাকে, যা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
খোয়াবনামা উপন্যাসের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
“খোয়াবনামা”র গল্প শুধু সামাজিক বা রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি; বরং ইলিয়াস দক্ষতার সাথে ঐতিহাসিক ঘটনার ফাঁকে ফাঁকে চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন, প্রেম, কাম, এবং দারিদ্র্যের কষাঘাতকে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র যেন বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি, যারা সবসময়ই ভাগ্যের নিষ্ঠুরতায় জর্জরিত।
ইতিহাস-আশ্রিত উপন্যাসে সাধারণত কল্পনার রঙ দিয়ে ইতিহাসকে সাজানো হয়। কিন্তু “খোয়াবনামা”য় ইতিহাসের ফাঁকে ফাঁকে সামাজিক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে। এ কারণে, এ উপন্যাসে গল্পের অবিচ্ছিন্ন রস নেই; বরং এখানে বাস্তবতার মোড়কে প্রতিটি ঘটনার বর্ণনা এসেছে, যা পাঠকের মনোজগতে এক অদ্ভুত মোহ সৃষ্টি করে।
খোয়াবনামা উপন্যাসের গভীরতা ও মানসিক প্রভাব
“খোয়াবনামা”তে লেখক হাসি-কান্নার মুহূর্তগুলোকে নির্লিপ্তভাবে চিত্রিত করেছেন, যেন সেসব লেখকের কোনো দায় নেই। লেখক বিশেষ কোনো আবেগে বর্ণনা করেননি ট্রাজিক মুহূর্তগুলো; বরং সেগুলো এসেছে স্বাভাবিক ছন্দে। তবে এই ট্রাজেডিগুলো যে মানবজীবনের গতিপথ কীভাবে পরিবর্তন করে, তা তুলে ধরতে লেখক কোনো কমতি রাখেননি।
উপসংহার
আহমদ ছফার মতে, “খোয়াবনামা” একটি মহাকাব্য। এটি একটি পরাজয়ের মহাকাব্য, যা বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বাঙালি জাতির মর্মমূলকে স্পর্শ করেছে। উপন্যাসের কাহিনী প্রবাহ সহজবোধ্য না হলেও, এর ভাষা, শৈলী, এবং বাস্তবতার নিরিখে এটি একটি অসাধারণ সাহিত্যকর্ম। পাঠকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি কাহিনী আরেকটু সরল হতো, তবে কি উপন্যাসটি আরো বেশি সুখপাঠ্য হতো? হয়তো হতো, তবে সেটা করতে গেলে উপন্যাসটি তার স্বকীয়তা হারাতো।
“খোয়াবনামা” পড়ার সময় পাঠককে ধীরে ধীরে বইয়ের গভীরে প্রবেশ করতে হয়, এবং সেখানে পৌঁছে তিনি অনুভব করেন এক গভীর মানসিক প্রভাব, যা তাকে বইয়ের শেষ অবধি নিয়ে যায়।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ধারার সূচনা করেছে, যা ইতিহাস, সমাজ, এবং বাস্তবতার সাথে কল্পনাকে মিশিয়ে এক অনন্য সাহিত্যকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
Leave a Reply